আরব বিশ্বের আঞ্চলিক সংগঠন আরব লীগ জানিয়েছে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা দখলের পরিকল্পনা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের দগণহত্যা ও অনাহারের নীতি’ বন্ধে চাপ প্রয়োগ করতেও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। ১১ আগস্ট সোমবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু। বার্তাসংস্থাটি বলছে, রোববার এক জরুরি বৈঠকে আরব লীগ গাজা উপত্যকা দখলের ইসরায়েলের পরিকল্পনাকে ‘সব আরব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি আগ্রাসন’ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে নিন্দা জানিয়েছে।

মিসরের কায়রোতে স্থায়ী প্রতিনিধিদের পর্যায়ের এই বৈঠক শেষে প্রকাশিত চূড়ান্ত বিবৃতিতে অংশগ্রহণকারীরা গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ‘গণহত্যা ও অনাহারের নীতি’ বন্ধে চাপ প্রয়োগ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে ইসরায়েলি দখলদার সরকারের গাজা উপত্যকার পূর্ণ সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করা এবং গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীর যার মধ্যে জেরুজালেমও রয়েছে এ ‘আগ্রাসন, গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল চালানোর পরিকল্পনার নিন্দা জানানো হয়।

আরব লীগ বলেছে, এসব সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন লঙ্ঘন, সব আরব রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আগ্রাসন এবং আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। গত শুক্রবার ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন করে, যা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার ও মানবাধিকার সংস্থার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।

আরব লীগ যৌথ মিসর-কাতার মধ্যস্থতার প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রকে দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের আগ্রাসন ও অপরাধ বন্ধ এবং এর অবৈধ দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে চাপ প্রয়োগের আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৬১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এই উপত্যকা দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে। গত বছরের নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়ায়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) গণহত্যার মামলা চলছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস এক হাজার ২০০ ব্যক্তিকে হত্যা ও আরও ২৫১ জনকে জিম্মি করে। ওই হামলার পর ইসরায়েলের পাল্টা হামলার মাধ্যমে শুরু হয় গাজার যুদ্ধ। তবে দুই বছরেরও বেশি গাজায় নিরবচ্ছিন্ন হামলা চালিয়েও হামাসকে পরাজিত করতে পারেনি নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী।সম্প্রতি হামাসকে পরাজিত করার চূড়ান্ত লক্ষ্যকে মাথায় রেখে ‘গাজা দখল’ করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যুদ্ধ অব্যাহত রাখা ও নতুন করে এর মাত্রা বাড়ানোর পরিকল্পনার প্রতিবাদে আগামী ১৭ আগস্ট ইসরায়েলজুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে কয়েকটি ইসরায়েলি সংগঠন।

হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সংগঠনের হাতে জিম্মি হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার ও নিহত সেনাদের পরিবারের সদস্যদের কয়েকটি সংগঠন এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সংগঠনগুলোর আশংকা, গাজা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে নেতানিয়াহু এগিয়ে গেলে জিম্মিদের জীবন বিপন্ন হবে এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফের) আরও সেনার প্রাণহানি হবে। ইতোমধ্যে এই ধর্মঘটের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা। ‘অক্টোবর কাউন্সিল’ নামের সংগঠন এর নেতৃত্ব দিচ্ছে।

তবে জিম্মিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘হোস্টেজেস অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিস ফোরাম’ এখনো এই কর্মসূচিতে সরাসরি সমর্থন দেয়নি।একইসঙ্গে, দেশটির শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন হিস্তাদ্রুত জানিয়েছে তারা এই কর্মসূচিতে অংশ নেবে না।সামরিক বাহিনী, তথা সেনাপ্রধানের আপত্তি সত্ত্বেও কয়েকদিন আগেই ইসরায়েলি যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় জনবহুল গাজা সিটি ও সংলগ্ন অঞ্চল দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন পেয়েছে।

সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগে জিম্মিদের জীবন বিপন্ন হবে, সেনারা অহেতুক ঝুঁকির মুখে পড়বেন এবং গাজা উপত্যকার মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আজ রোববার তেল আবিবে সংবাদ সম্মেলনে ১৭ আগস্টের ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিরিয়া সামরিক ঘাঁটির বিপরীত দিকে এটি আয়োজন করা হয়। সেখানে সামরিক বাহিনীর সদরদপ্তর ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান। আয়োজকরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক ইউনিয়ন ও সার্বিকভাবে, দেশের সব নাগরিককে সেদিন কাজে না যেয়ে ‘অর্থনীতির চাকা অচল’ করে দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলি গণহত্যামূলক হামলা থেকে রেহাই দেওয়া বা তাদেরকে মানবিক সংকট থেকে রেহাই দেওয়া নয়, এই ধর্মঘটের উদ্দেশ্য হিসেবে আয়োজকরা উল্লেখ করেন, ‘ইসরায়েলি জিম্মি ও সেনাদের প্রাণ রক্ষা করা ও নিশ্চিত করা, আর কোনো পরিবারকে যেন শোকের সাগরে ভাসতে না হয়।

বিরোধী দলের নেতা ইয়ার লাপিদ এই ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এক্সে পোস্ট করেছেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি স্থবির করে দেওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তার পেছনে যুক্তিপূর্ণ ও মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা (আয়োজকদের) পাশে থাকব।বামপন্থি ডেমোক্র্যাটস পার্টির প্রধান ও আইডিএফের সাবেক উপ-প্রধান ইয়াইর গোলান ধর্মঘটের পক্ষে বক্তব্য দেন।তিনি ‘ইসরায়েলের সব নাগরিককে’ এতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান এবং যুক্তি দেন, গাজায় (জিম্মি থাকা) আমাদের ভাই-বোনদের’ উপেক্ষা করে দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো করে যাওয়া সম্ভব নয়। শনিবার রাতে ইসরায়েলজুড়ে হাজারো মানুষ নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেন। এসব বিক্ষোভ থেকেই ধর্মঘটের চিন্তা সামনে আসে।বিক্ষোভকারীরা দাবি জানান, যুদ্ধের মাধ্যমে গাজা দখলের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সরকারের উচিত স্বয়ংসম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে যুদ্ধের অবসান ঘটানো, যাতে সব জিম্মি নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন।

গত বৃহস্পতিবার রাতভর বৈঠকের পর শুক্রবার সকালে মন্ত্রিসভায় নেতানিয়াহুর প্রস্তাবিত ‘সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সম্প্রসারিত’ সামরিক অভিযানের মাধ্যমে গাজা দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন পায়।মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর নেতানিয়াহু জানান, তিনি পুরো গাজা উপত্যকার দখল নিলেও নিজের কাছে নিয়ন্ত্রণভার রাখবেন না। একটি ‘আরব প্রশাসন’ গাজার প্রশাসনিক দেখভালের দায়িত্ব নেবে। তবে ওই ‘আরবদের’ ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাননি ইসরায়েলি নেতা।তিনি আরও নিশ্চিত করেন, হামাসকে বিদায় করার পর সরকার কীভাবে কাজ করবে, তা জানাতে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হবে। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলও গাজার বেসামরিক সরকারে কোনো ভূমিকা রাখবে না বা মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষেরও এখানে কোনো ভূমিকা থাকবে না।